Sunday, July 5, 2009

আমার সময়

বৃহত্তর ময়মনসিংহের নেত্রকোণা জেলার সীমান্তঘেষা দুর্গাপুর থানার একটি গ্রাম গোপালপুরে কেটেছে আমার শৈশব-কৈশোর। অলি-গলি পাহাড়ি পথ আর আদিবাসী জনাধিক্য জনপদে কেটেছে সেই সময়। পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া দাদার ভিটেবাড়িতে আমরা পাঁচ ভাইসহ বাবা-মায়ের সংসার। পাহাড়ের চূড়ায় একটি মিশনারি স্কুল পরে সরকারিকরণে ‘গোপালপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’-এ ছিল আমার প্রথমিক পাঠ।
তখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ি। সে সময়ের এক ডিসেম্বর মাস। শাদাকালো পর্দায় বাংলাদেশের একমাত্র টিভি চ্যানেল বিটিভি-তে মুক্তিযুদ্ধের একটি ছবি দেখানো হয়। ছবিটি অসাধারণ প্রভাবিত করে আমাকে। এরকম যে বড় হয়ে একদিন আমি ডাক্তার হবার পাশাপাশি একজন চলচিত্র পরিচালক হবো। একজন নায়কও হবো। কিন্তু একজন লেখক-কবি হবো এরকম কোনোদিন ভাবিনি। ছবিটির নাম বা বিষয়বস্তু আজ আর মনে নেই। যাহোক সে বছর কিংবা তার পরের বছর একই কাহিনী নাম-চরিত্র পাল্টিয়ে একটি গল্প তৈরি করে ফেলি। গল্পটির নাম দিই ‘স্বাধিনতার সূর্য’। পরের বছর ডিসেম্বর মাসে আমাদের সংগঠন ‘চেতনা ক্লাব’ আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানে নাটক হিসাবে প্রদর্শিত হয় এবং নাটক শাখায় দ্বিতীয় পুরষ্কার পায়। সেই থেকে লেখালেখির শুরু। তারপর তিন/চার বছর আর কোনো লেখালেখি নেই। নকল করে লিখে ফেলার লজ্জাবোধ থেকে কিংবা লেখালেখির বিদগ্ধতা স্পর্শ করেনি বলেও হতে পারে।
প্রথম কবিতা লিখি ১৯৯৪ সালে নেত্রকোণায় নানাবাড়ি প্রতাপপুরে। আমার জন্মগ্রামও এই প্রতাপপুর নানাবাড়িতেই। কবিতাটির নাম ‘ঝিঁঝিঁ’। একদম রাতের দ্বিপ্রহরের শব্দ-নৈঃশব্দ্য, পরিবেশ-প্রতিবেশ আর ভয়ার্ততা নিয়ে লেখা কবিতা। এরপর থেকে নিয়মিত লিখে আসছি অদ্যাবধি। এই কবিতাটির অস্তিত্ব আজ আমার কাছে নেই। শুধুমাত্র এই কবিতাটি নয় আরো প্রায় ২০০/২৫০ কবিতা এবং চারটি উপন্যাস কিছুই হয়নি বলে একদিন মন খারাপ করে ‘গোগড়া’ বিলে জলাঞ্জলি দিয়েছি। ওই সময় মনে হয়েছিল ঠিকই করেছি কিন্তু আজ খুব ক্ষোভ হয় এর ভেতরেই নিশ্চয় শত লেখনির প্রেক্ষাপট নিহিত রয়েছিল। প্রথম দিকে আমার লেখালেখি বিষয়ে পরিচিত জন কিংবা আত্মীয় বা পরিবারের কারো বিশেষ কোনো পক্ষপাত ছিল না বলেই মনে পড়ছে। লেখালেখির অন্তরা অর্থাৎ অন্তশ্চক্ষু সজাগ হবার পর থেকে মনে হয়েছে আমার প্রেরণা কেবল আমিই। তবে মাধ্যমিক শিক্ষাকালিন বাংলায় আমাদের সহপাঠ ছিল শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘শ্রীকান্ত’। কৈশোরের ওই মর্মস্পর্শী আবেগময় সময়ে এই উপন্যাসটি আমার মনে বিশেষ রেখাপাত করেছিল। ইমদাদুল হক মিলনের ‘চারটি প্রেমের উপন্যাস’-এর প্রভাবও পড়েছিল বোধহয়। তারপর উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে নিতান্তই অবমূল্যায়নে পড়ে থাকা স্থানীয় একজন কবি ফজলুর রহমানের কাব্যগ্রন্থ ‘উড্ডিন কার্নিশ’ বইটি কবিতার প্রতি আমার মনযোগের উদাহরণ হতে পারে। এই বইটি ছিল আমার মায়ের এক চাচাতো ভাই আজিজুল হকের ‘জনপ্রিয় পাঠাগার’ নামে প্রতাপপুরের গণ-লাইব্রেরিতে। বাবার চাকরিসূত্রে আমাদের পরিবার যখন দাদার ভিটেমাটি ছেড়েছুঁড়ে নানাবাড়িতে চলে আসি তখন ওই লাইব্রেরিটি এলাকায় প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। লাইব্রেরির কোন এক সদস্যের বাড়িতে বইটি অবহেলায় পড়েছিল। এরপর থেকে বলবো নিজে নিজেই আমি ছোট্ট একটি ব্যক্তিগত পাঠাগার তৈরি করেছিলাম। সে সংগ্রহে শুধু দেশিয় আমাদের পরিচিত লেখকদের বইই নয় ‘দেশ’ পত্রিকার ৫০ বছরের নির্বাচিত কবিতাসহ একেবারে পশ্চিমবঙ্গের বাঘা বাঘা লেখকদের বইও সংগ্রহ করেছিলাম। প্রথমদিকে নেত্রকোণায় যেসব বন্ধু-কবি’র সাথে পরিচয় হয়েছিল তাদের কেউ কেউ তো আমার সংগ্রহের কথা শুনে আতকে উঠতো। ‘তোমার সংগ্রহে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাসমগ্র আছে? দাও, দাও আমাদের পড়তে দাও বলে পড়ার জন্য বন্ধু-বান্ধব বই নিতো। আবার বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, সুভাষ মুখোপাধ্যায়সহ আরো কয়েকজন বিখ্যাত কবির স্বকণ্ঠে কবিতা আবৃত্তির ক্যাসেট আছে জেনে কেউ কেউ হয়তো চাইতো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজিয়ে শোনানোর জন্য। কেউ কেউ আশ্চর্য হতো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ অনুবাদ বই ‘অন্যদেশের কবিতা’ আমার সংগ্রহে আছে বলে। কেউ কেউ জীবনানন্দ দাশের ‘প্রকাশিত অপ্রকাশিত রচনাবলী’র জন্যে’। কেউ কেউ আদ্রে মরোয়া’র ‘শিল্পীর সাধনা’র জন্যে। কেউ কেউ সৈয়দ আলী আহসানের ‘শিল্পবোধ ও শিল্পচৈতন্য’র জন্যে, কেউ কেউ ‘কবি ও কবিতা: শার্ল বোদলেয়ারের জন্যে’, কেউ কেউ ‘ফ্রিডরিশ হ্যোল্ডারলিনের ‘নিয়তি ও দেবযান’-এর জন্যে, কেউ কেউ আলডাস হাক্সলির ‘লক্ষ্য ও পথ’-এর জন্যে। আশ্চর্য হওয়াও স্বাভাবিক ছিল। আমার সৌভাগ্যই বলবো ওই সময়েই আমি বিষাদ সিন্ধু, রামায়ণ, মহাভারত, ইলিয়াড, ওডিসি’র চিলড্রেন সংস্করণ, মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের রচনাসমগ্র, আবুল হাসনাতের ১৪০০ পৃষ্ঠার দুইখ- যৌনবিজ্ঞান, আবুল মনসুর আহমদের ‘আত্মকথা’র মতো বিখ্যাত বইগুলো পড়ে ফেলেছিলাম। নেত্রকোণা সদর থেকে প্রতাপপুরের অবস্থান সন্নিকটে হলেও শিক্ষার উজ্জ্বল আলো ছিল না সেখানে। বিদ্যুতের সংস্পর্শ তো ছিলই না কেরোসিনের আলো আর মাকড়শার জালে আবৃত ছিল ছোট্ট আমার সনে ছাওয়া পড়ার ঘর। ওইরকম একটি প্রতিবেশে থেকে আমার কবিতাচর্চা অস্বাভাবিক বোধ হওয়া অস্বাভাবিক ছিল না।

নদীর জলে নৌকো ভাসে / মাঝি ভাসে না / ঘাটের মানুষ ব্যাকুল সবাই / মাঝি মেলে না...
তুলসীতলায় প্রদীপ জ্বলে / প্রদীপ জ্বলে না / বাগান জুড়ে গোলাপ ফুটে / গোলাপ দেখি না...
মনের কথা যায় রে ছুটে / মনের গহীনে / প্রাণের কথা শুধায় মানুষ / মনের আড়ালে...
আমাদের কবিতীর্থ বকুলতলা ছেড়ে আমাকে দাঁড়াতে হবে ঠিক নিজের সামনে, এ এক কঠিন কাজ। হ্যাঁ, কাজ। মূলত কাজ নিয়ে কথা। কাজ তো ছিলই ‘হাওড়’ । লোকে বলে ছোটকাগজ, আমি বলি ছোট আকৃতির কাগজ। মূলত এ বঙ্গে ছোটকাগজ কন্সেপ্ট-টি পরিষ্পার নয় বলেই মনে হয়। আমার প্রতিবেশ জোর করে বাধ্য করলো বকুলতলা ছাড়তে। আসলে এত তাড়াহুড়া ছিল না আমার। ‘আমার বামচোখে বাস করে এক ঋষিতারা / আমার চোখের উপর বসে সে দেখতে পায় / আলোছায়াময় মাঠ, পুকুর ঘাট, স্বপ্নঘেরা সবুজ বনানী।’ হ্যাঁ, আমার প্রথম ঋষি মাহবুব কবির, সন্ধ্যাকুড়া। কখনো সে আগে কখনো আমি আগে উপস্থিত হতাম সেখানে। একে একে মাহবুব কবির, আশরাফ রোকন, মিজান মল্লিক, রাজীব আর্জুনি, শিমুল মিলকী সবাই কাজে লেগে গেলো, মামুন খান চলে এলো ঢাকায়। অবশিষ্টাংশ ছিলাম আমি, আবদুর রাজ্জাক এবং সোমেশ্বর অলি তাও বিচ্ছিন্ন হতে হলো। মফস্বল ছেড়ে ঢাকায় আসা, নিত্য নতুন নাগরিক-সামাজিকতার মধ্যে ঢুকে যাওয়া উঠতি তরুণের চোখে কী এক স্বপ্ন বহমান! স্বপ্ন নিয়ে মানুষ বাঁচে, আমারও আছে সাহিত্য প্রকাশনা সম্পাদনা। সাহিত্য সম্পাদনা! কিংবা হয়ে ওঠা একজন সফল সাহিত্য সম্পাদক। প্রতিটি লেখকই আসলে সাহিত্য সম্পাদক তার নিজের মধ্যে। আমি এখন আমাদের সময়ের সাহিত্য প্রকাশনার মধ্যে। ফলে আমাকে ভাবতে হচ্ছে, রাশি রাশি মেঘপুঞ্জ, / পথে পথে পদ্যনুড়ি, বৃক্ষের নিরব শোভা / দূর কোনো গাঁয়ে, পাতাদের মর্ম প্রজ্বলিত। হ্যাঁ, আবারও কোথাও এক প্রজ্বলন টের পাই, পাতাদের প্রজ্বলন। এখন দূরের কোনো গাঁয়ে প্রচ- শীত পড়েছে, আমার বকুলতলায়ও এখন শীতের আবহে বসে আছে দুইখ-ে গাজী মোবারক হোসেন, কামরুল হাসান খান, ইয়াসিনুর রহমান, আশরাফ রোকন, অনিন্দ্য জসিম, শিমুল মিলকী অদূরে আবু তাহের, কাজল, সেন্টু ভাই, নিরঞ্জন’দা আমি দেখতে পাচ্ছি, পুড়ছে অমুদ্রিত অসংখ্য পাতার স্তুপ। পাতাদের জীবনী কি লেখা হয়? মাঝে মাঝে নিজের মধ্যে প্রশ্ন এসে জাড়িত হয় পাতাদের জীবনী লেখা হয় না কেনো?
২০০৪ সাল। বসে আছি আমাদের সময়ের সাহিত্য প্রকাশনা সম্পাদনার টেবিলে। টোকন’দা আমার সময় নিয়ে লিখতে বলেছেন। আমার সময়! এখনই যদি লিখতে হয় তাহলে অগ্রজদের সময় কখন লেখা হবে? এরকম লেখা ইতিপূর্বে লিখিনি কখনো ফলে আমার দুর্বল হাত যথেচ্ছ লেখাটি তৈরি করতে পারছে না। টোকন’দা তার চঞ্চল স্বভাবে বারবার ঘুরে ফিরে দেখছেন লেখাটি আর কতদূর? কখনো কখনো পিঠের উপর স্কেল দিয়ে বাড়ি চালাচ্ছেন অস্থিরতায়। সম্পাদক-প্রকাশক নাঈমুল ইসলাম খান মানে আমাদের নাঈম ভাই আমার সময় নিয়ে লিখতে বলেছেন। আমাদের সময়ের ডামি ইস্যু তখন প্রায় প্রতিদিনই বেরুচ্ছে, ডামিতে লেখাটি ছাপা হবে। তপন’দা তাগিদ দিচ্ছেন চলচ্চিত্রের উপর একটি লেখা তৈরি করতে। খুব জোর দিচ্ছেন যেন লেখাটি দ্রুত তৈরি হয়। আর আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি আমার লেখনি কে খেয়ে ফেলার এক প্রচ- শক্তি হামলে পড়ছে আমার উপর। ফরিদ কবির দুই জালিমকে নিয়োগ করেছেন আমার লেখনি কে খেয়ে ফেলার জন্য। এরা দুপুর বেলায় আমাকে লিখতে বলে আগে আগে নিজেদের খাবারের পাঠ চুকায়। মাথায় সাহিত্য নামের ভূত, আসলো কেনো? আমি কি ডেকেছি নাকি? বারবার আমাকে এই দোষ দিয়ে এরা নিজেদের লেখনি চালিয়ে যাচ্ছেন। সকল প্রশংসা তাহার... চোখ ছিল না চোখে ফলে লেখা হলো / জিভের কাহিনী, নুনবিশ্বে; সাচ্চা কথা / হলেও হতে পারে, ধরে নিতে পারো / আমার নুনদাতা সর্বদাই নত করে রাখে / মস্তকের দৃঢ়তা। গ্রামে বসে যখন আধুনিক সাহিত্যের কথা চিন্তা করছি আমার সময় তখন দেরিদা / ফুকো’র তত্ত্ব, পোস্টমর্ডানিজম, টু পোয়েট্রি - রি পোয়েট্রি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। তখন মুক্তকণ্ঠের খোলাজানালার সময়। সত্যি কথা বলতে, আবু হাসান শাহরিয়ার, টোকন ঠাকুর, শহিদুল ইসলাম রিপনের সম্পাপদনায় পাতাটি খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছিল সে সময়। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, ধারাবাহিক গদ্য ছাড়াও চিত্রকলা, সমালোচনা, ভ্রমণ, অনুবাদ, পাঠকের প্রতিক্রিয়া লেখকের জবাবসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ / মজার লেখা মুদ্রিত হয়েছে। এখনও আমার ওইপাতায় মুদ্রিত অনেক লেখার শিরোনাম মনে আছে। ‘শাদাশাড়ি’ শিরোনামে আমার একটি কবিতাও ছেপেছিলেন শাহরিয়ার ভাই কিংবা শুচি সৈয়দ-ও হতে পারেন। উড়ে যাও শাদাশাড়ি বলো তারে / আগুনে পোড়েই শূন্যতার ঘর করি / ওগো মেঘ, আষাঢ়ের মেঘ ঝরে যাও / উজান গাঙের পানি, বেহুলা ভাসাই ভেলা / সাথে দিই পরাণের লখাইরে / নিয়ে যাও উজান ঘাটের বেদে বাড়ি / সাত ভাইয়ের চম্পা আমি। শুক্রবার সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম চিন্তা ছিল কিভাবে ওই পাতাটি সংগ্রহ করা যায়। রিক্সায় কিংবা সাইকেলে চড়ে পত্রিকা হকারের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম চার/পাঁচ জন। মাহবুব কবির, সরোজ মোস্তফা, মিজান মল্লিক, রাজীব আর্জুনি, আমি এবং আরো অনেকে। পত্রিকাটি হাতে পেয়ে গেলেই দুর্বার গোষ্ঠী ভবনের বারান্দায় জমে যেতো ছোট্ট একটি আড্ডা। শুধু ওই পাতাটি নিয়েই নয়, আলোচনা ক্রমশ দীর্ঘ হয়ে যেতো সাহিত্যের সঙ্গ-প্রসঙ্গ নিয়ে। যখন ক্লান্ত দুপুর ওই দিনের পাওয়া সাহিত্যের তলানিটুকু মাথায় নিয়ে তখন বাড়ি ফিরতাম। সেই থেকে সাহিত্যের প্রতি ঝোকটা প্রবলভাবে বাড়তে থাকলো। দৈনিকে আমার প্রথম কবিতাটি ছাপেন জাফর আহমদ রাশেদ ভোরের কাগজে। প্রচ- উৎসাহ পেয়েছি ওই কবিতাটি ছাপার পর। ‘পদ্মা কিবা গঙ্গা’ নামে দুই বাংলাকে একত্রিকরণই ছিল কবিতাটির মূল ভিত্তিভাষ্য। প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায় পাঠানো কবিতাগুলো ব্রাত্য রাইসু কখনো ছাপতেন না। সাজ্জাদ শরিফ, ব্রাত্য রাইসুর সম্পাদনায় এই পাতাটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ পাঠকের কাছে। সাম্প্রতিকে এই পাতাটির মান একটু কমেছে বলে মনে হয়। এখন এই পাতাটিতে (সাহিত্য সংকটেই বোধ হয়) মাঝে মাঝে বিজ্ঞাপনও লক্ষ্য করি।
২০০০ সালে আমিসহ আমাদের ছয় তরুণ কবিমিলে শ্রাবণ থেকে প্রকাশ করি সমন্বিত কাব্যগ্রন্থ ‘হট্টিটিগুচ্ছ’। নিজের কবিতা গ্রন্থাকারে দেখে কি আনন্দ লেগেছিল তা এখন অনুভূতিতে আসছে না। বহুদিন পর আজ মনে হচ্ছে কি প্রয়োজনই ছিল ওই দুর্বল কবিতাগুলো দিয়ে গ্রন্থ প্রকাশ করার। গ্রন্থভুক্ত ছয়কবির মধ্যে আমার লেখাই বোধহয় দুর্বল ছিল। সে বছরই সিদ্ধান্ত নিই ছোটকাগজ করার। নামও ঠিক করে ফেলি ‘হাওড়’। কিন্তু কিভাবে প্রকাশ করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। অবশেষে নিজের জমানো ২০০০ টাকা আর বন্ধু রানা নাগের আশ্বাসে সিদ্ধান্ত নিই কাগজটি প্রকাশ করার। স্থানীয় কয়েকজন লেখকের লেখা আর উপার্জিত বিজ্ঞাপনের সামান্য কয়েকটি টাকা নিয়ে চলে আসি জগন্নাথ হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রানার ছাত্রাবাসে। রানা ছাত্ররাজনীতির সংগে যুক্ত থাকায় থাকাসহ সকালের নাস্তা, চা-সিগারেট থেকে দুপুরের খাবার, রাতের খাবার মোটামুটি ফ্রি হয়ে গেলো। শুধু এই নয় রানা আরো নগদ ১ হাজার ৮০০ টাকা দিয়ে রেখেছিলো। কথা ছিল কাগজ বের করতে যত টাকাই লাগুক সে দেবে। প্রথম সংখ্যা প্রকাশ হবে, মনে অন্য রকম উত্তেজনা কাজ করতে থাকলো। সেই আনন্দেই কাজ করতে ভালো লাগছে। মুজিব ভাই, মাহবুব ভাই বা আরো পরিচিত যারা, পরিচিত হচ্ছে যারা তাদের মধ্য থেকেই শ্রাবণে কম্পোজ দিই। প্রুফ দেখি, দুপুরে খাবারের জন্য হলে চলে যাই ফিরে এসে ক্লান্ত বিকেলটা শ্রাবণের দোতলার বারান্দায় শুয়ে থেকে কাটিয়ে দিই। সন্ধ্যা নাগাদ তরুণ লেখকদের ভিড় বাড়তে থাকে তখন আড্ডায় মিশে যাই। কিন্তু সংখ্যাটি প্রকাশ করতে গিয়ে মোটামুটি একটি বিপত্তি পোহাতেই হলো। যখন প্রকাশনার কাজ প্রায় ওকে হয়ে এসেছে। রানা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে বা নিজের থেকে আরো কিছু টাকা ম্যানেজ করে দেয়ার কথা। দিন ১৫ যেতে না যেতেই রানা তার দেয়া টাকা থেকে কিছু টাকা চাইলো, বললো শ’তিনেক হলেই চলবে। টাকাটা দিলাম আর অবস্থাটা ওকে বোঝালাম। ও বললো সমস্যা নেই যতদিনই লাগুগ ভালো একটি কাগজই আমরা করবো। দু’একদিনের মধ্যেই ক্যান্টিনে আমার কাছে খাবারের টাকা চাইলো। রানা আগেই বলে রেখেছিলো কিন্তু খাবারের টাকা বেড়ে যাওয়ায় ওরা খাবার দিতে চাইলো না। ওদের-কে দিলাম ৩০০ টাকা। সকালের নাস্তা ব্যাতীত আমার আর কোনো সুবিধাই থাকলো না রানার ওখানে। ক্রমশ রানা হাওড় বিষয়েও উদাসিন হতে থাকলো। অল্প দিনের মধ্যেই বিপদে পড়ে গেলাম। শ্রাবণের টাকার তাগাদা আর দুবেলা খাবারের টাকা দিতে গিয়ে লজ্জায় পড়তে হলো, কাগজটি আর বেরুবে না বলেই হতাশ হলাম। এভাবে সপ্তাহখানেক পার হয়ে গেলো। মুজিব ভাই, মাহবুব ভাইকে সমস্যার কথা বললাম বিশেষ কোনো ফল হলো না। মুজিব ভাই সহযোগিতার জন্য প্রথম আলোর সাংবাদিক তরুণ সরকার-কে বলে দিলেন কিন্তু লোকটাকে যথেষ্ট বিনয়ী মনে হলেও হাওড় বিষয়ে বিশেষ উৎসাহী হলেন না তিনি। আমিও আনমনে একজন পূণ্যার্থীর মুখের দিকে তাকানো ব্যাতীত তাকে বিশেষ কোনো ভদ্রতায় আকর্ষণ করতে পারেনি সে সময়। তরুণ’দার সাথে দেখা হলে সুন্দর সম্ভোধনে এখনও ডাকেন তিনি। মাহমুদ সীমান্ত, সম্পাদক: হাওড় বিশেষ কোনো সহযোগিতা করতে পারলাম না আজও। সহযোগিতার জন্য এগিয়ে এলেন সম্পূর্ণ অপরিচিত একজন। এমনিতেই শ্রাবণে দেখা-সাক্ষাত হয়েছে হয়ত দুয়েকবার, কথা হয়নি তখনো। আমার মনে আছে, শ্রাবণের দোতলার বারান্দাতে অপেক্ষাকৃত স্বল্পদৈর্ঘের একজন মানুষ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কাগজটি বেরুচ্ছে না কেনো? বললাম, একটু সমস্যার জন্য সহসাই কাগজটি প্রকাশ করতে পারছি না, তবে শীঘ্রই প্রকাশিত হবে। এর বেশি নয়, উনি জিজ্ঞেস করলেন আপনি আগামীকাল এখানে আসবেন? আমি বললাম প্রতিদিনই তো আসছি, আগামীকালও আসবো। ঠিক আছে, এলে দেখা হবে বলে চলে গেলেন। তার পরদিন যথারীতি উনি এলেন এবং প্রায় একই জায়গাতেই উনার সাথে দেখা, পকেট থেকে দুটো পুরনো ৫০০ টাকার নোট আমার হাতে দিয়ে বললেন, আমি রাজীব নূর, প্রথম আলোতে জব করি ১১ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পাই তাতেও আমার চলে না। টাকাটা রাখেন আপনার ম্যাগাজিনটা বেরিয়ে গেলে আমাকে টাকাটা শোধ করে দিয়েন। ওই টাকাটা পরিশোধ করেছি সে বছরই দুবার ঢাকায় আসার পর যখন উনার সাথে দেখা হয়েছে। আমার অবাক হওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। লোকটা তখনও রাজীব নূর নামে আমার কাছে অপরিচিত। পরে হয়ত মুজিব ভাইয়ের কাছেই জিজ্ঞেস করে জেনেছি। তরুণ, সিরিয়াস ধারার গল্পকার উনি ‘দ্রৌপদী ও তার প্রেমিকেরা’ এই নামে একটি গল্পবই প্রকাশিত হয়েছে বাংলা একাডেমী থেকে। পরে বইটি তাঁর কাছ থেকে সংগ্রহ করেই পড়েছি আমি। বইটি খুবই ভাল লেগেছে। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য হলো তার পরের বই ‘হরিণা ও সোনারতরী সকাল’সহ দুটো বইই আমার হাতছাড়া হয়ে গেছে আর বহুচেষ্টার পরও উনার লেখা গল্প আমি হাওড়ে মুদ্রিত করতে পারিনি। শুনেছি উনি ছোটকাগজের সম্পূর্ণ কট্টর লেখক না হলেও একটু বেছে বেছেই লিখে থাকেন। রাজীব’দার মাধমেই হাওড়ের পরবর্তি দুটি সংখ্যাতে ঐতিহ্যের বিজ্ঞাপনটি পেয়েছি। আরিফুর রহমান নাইম খুব ভালো এমাউন্টের টাকা দিতেন না যদিও কিন্তু বিজ্ঞাপন ছাপা হবার পর বইমেলায় দেখা হলে টাকা চাওয়ার পর টাকাটা দিতে কার্পণ্য করতেন না। রাজীব’দার সাথেও বেশকিছু আড্ডার স্মৃতি আছে আমার। শাহবাগ পিজির সামনের মোড়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হেকিম চত্বর, বাংলা একাডেমি, প্রথম আলো তার অফিসে কতবার যে আমরা বাংলাদেশের ছোটকাগজ, প্রকাশনা তথা সমকালিন সাহিত্য নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা করেছি! শাহবাগ পিজির সামনের মোড়ে বসে একদিন আড্ডা দিচ্ছি, কথা হচ্ছিলো বাংলাদেশের ছোটকাগজ নিয়ে। প্রসঙ্গক্রমে মুজিব মেহদী, কারা সাধারণত ছোটকাগজের লেখক, ছোটকাগজের সহযোগি হয়ে উঠেন, কারা হয়ে উঠতে পারেন না, হয়ে উঠতে চান না এইসব। হঠাৎ রাজীব’দা বললেন সীমান্ত আপনি বইয়ের পা-ুলিপি তৈরি করলে একটা আমাকে দিয়েন। বাংলাদেশের অনেক ভালো প্রকাশনা সংস্থার সাথে আমার সম্পর্ক রয়েছে, আপনার বইটি আমি প্রকাশের ব্যবস্থা করে দেবো। রাজীব’দার সাথে ঐতিহ্যের নাইম ভাইয়ের ভালো সম্পর্ক আমি প্রত্যক্ষ করেছি। বিষয়টি আমার মাথায় ছিল। ২০০৫ সালে বইমেলা শুরুর কয়েকদিনের মধ্যে ঐতিহ্যে রাজীব’দার নামটি যুক্ত করে নাইম ভাইকে ই-মেইলে আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থের পা-ুলিপি ‘পাতার জীবনী’ দিয়েছি। বইমেলায় একদিন নাইম ভাইয়ের সাথে দেখা হলো উনি আমার পা-ুলিপি প্রাপ্তি স্বীকার করে বললেন, এখন তো বইমেলা প্রায় ১৫ দিন পার হয়ে গেছে কাজেই এ বইমেলায় আর বইটি প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া ঠিক হবে না। এরপর নাইম ভাইয়ের সাথেও বই বিষয়ে আর কোনো কথা হয়নি। রাজীব’দার ওই মহান কৃতির জন্যই আমি বলবো সে সময় হাওড় প্রকাশিত হতে পেরেছিল। আজন্ম আমি তার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি। আরো দুজনের কথা না বললেই নয়, একজন সোনালী ব্যাংকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আবদুর রাজ্জাক (সাইমুম রাজু নামে লেখালেখি করেন), অন্যজন রানার ছোটভাই সানার বন্ধু-সহপাঠী সুব্রত পাল পিংকু। সোনালী ব্যাংক জনসংযোগ শাখায় উপ-পরিচালক হিসবে কর্মরত ছিলেন নেত্রকোণারই একজন। আমার বাবা একজন সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়ি পরিচয় দেবার পরও যখন উনি সহযোগিতা করলেন না তখন রাজু ভাই নিজের প্রকাশনা সংস্থা ‘দোয়েল’-এর একটি হাফপেজ বিজ্ঞাপন দিয়ে আমাকে ৫০০ টাকা দিলেন। সাথে পজিটিভ বা ট্রেসিং-এর জন্য আরো ৫০ টাকা দিলেন। উনার প্রকাশনা সংস্থা ‘দোয়েল’ থেকে প্রকাশিত আমার ‘পাঠসূত্র’ প্রকাশক পর্ষদের একজন, তরুণ কবি (সাহেদ) শাহেদ কায়েসের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বাঁক ফেরার অভিজ্ঞতা’ এই রাজু ভাইয়ের কাছ থেকেই সংগ্রহ করে পড়েছি। উল্লেখ্য, রাজু ভাই ‘সূচক’ নামে একটি ভালো ছোটকাগজের সম্পাদক ছিলেন ফলে ইনিও একজন নবাগত ছোটকাগজ কর্মীর মর্মবেদনা কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন বোধহয়। রাজু ভাই শুধু এটুকুই নয় হাওড়ের পরবর্তি দুটি সংখ্যাতে সোনালী ব্যাংকের বিজ্ঞাপনসহ রূপালী ব্যাংকের একটি বিজ্ঞাপনের ব্যবস্থা করে দিলেন। এই মানুষটির প্রতিও আমার একজন বড় ভাইয়ের মতো শ্রদ্ধা জেগে আছে। কিন্তু ২০০৩ সালের পর হাওড় প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যাবার পর থেকে তাঁর সাথেও আর ভালো যোগাযোগ নেই। মন কত টানে কিন্তু যোগাযোগই যেন আর হয়ে উঠছে না। পিংকুর নবীন মনটি আমার প্রতি কিভাবে দুর্বল হয়ে উঠেছিল বুঝতে পারিনি। হয়ত হাওড় প্রকাশনা নিয়ে রানার রুমে আমাদের বাক-বিত-া, তর্ক-বিতর্ক থেকেই ওর মনটা দুর্বল হয়েছিল। হঠাৎ একদিন আমার হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে বললো দাদা, এই টাকাটা রাখেন আপনার কাজে লাগবে। পিংকুর সাথেও অনেকদিন দেখা নেই। দীর্ঘদিন পর ওর একটি চিঠি পেয়েছিলাম তাতে বিশেষ একটি কারণে লজ্জাবোধে তাড়িত হয়ে চিঠিটি লিখেছিল সে, ওর লজ্জা পাওয়ার কিছুই ছিল না অবশ্য। তার আরো অনেকদিন পর জানলাম পিংকু ইন্ডিয়ায় ওর পড়াশোনা শেষ করে ভারতীয় হাই কমিশনের চাকরি নিয়ে দেশে ফিরেছে। অনেক কষ্টেসৃষ্টে ওর ই-মেইল এড্রেস ম্যানেজ করলাম যখন তখন সে আবারো উচ্চ শিক্ষার জন্য ইন্ডিয়ায় চলে গেছে। ওর শেষ চিঠি থেকে মোটামুটি কষ্টই পেয়েছি আমি। ও লিখেছিল দাদা, আপনার সাথে হয়ত আর আমার দেখা হবে না। এখন এখানে আমিও কবি, কবিতা লিখি তবে কবি পরিচয়ে আপনার সামনে দাঁড়াবার যোগ্যতা আমার নেই। ওকে সত্যি খুব দেখতে ইচ্ছে করেছিল সে সময়। আমাদের সময় থেকে আমাকে ড্রপ করা হলে বছরতিনেক আমি নেত্রকোণা ছিলাম। ফিরে এসে পাঠসূত্রে নির্বাহী হিসেবে যোগ দেবার পর ওকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম দেশে এলে অফিসে আসার কিংবা মোবাইলে যোগাযোগ করার জন্য। প্রথম মেইলের জবাব দিলেও দ্বিতীয় মেইলের জবাব আর দেয়নি। জানি না ও বৈদেশ মনীষায় আজ কেমন আছে? কতবড় লুকোচুরির কবি হয়েছে সে খুব জানতে ইচ্ছে করে।
ঢাকায় প্রথম প্রথম যখন আসতাম বেশ ভালো লাগতো শাহবাগের সাহিত্যের আড্ডা। আজকের গুরুত্বপূর্ণ জনপ্রিয় তরুণ কবি-লেখকদের খুব চমৎকার আড্ডা বসতো এই বছর পাঁচেক আগে। মূলত বই, বইপড়া, সাহিত্য, লেখালেখি, প্রকাশনা এইসব নিয়েই ছিল শাহবাগের কবি-লেখকদের সমাগম। আজিজ মার্কেটের দোতলায় শ্রাবণ প্রকাশনের শো-রুম ও তার পুবের বারান্দা লোক প্রকাশনা সংস্থার শো-রুম নিচতলায় পাঠক সমাবেশ / বইপত্র-এর সামনের অংশ ধরে ছিল লেখকদের দীর্ঘ আড্ডা। এর বাইরে পিজির পিছনের বারান্দা ও তার সামনের অংশটি জুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে তিন/চারটি আড্ডা ছিল। এটি ছিল আমার সময়ের একটু পূর্বের অবস্থা। হঠাৎ করে সময়ের লেখকরা নিজেরা কামড়াকামড়ি করে, অনেকে আবার কর্মের প্রয়োজনে শাহবাগের চমৎকার এই আড্ডাটি হারিয়ে ফেলেছে। প্রকৃত আমার সময়ের লেখকরা বলতে গেলে এখনও তেমন গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় আসেনি দু’চারজন ছাড়া। শাহবাগে এখন নতুন কবি-লেখকদের সংখ্যা বেড়েছে, এরা কেউ কেউ সিরিয়াসলি সাহিত্যকে ভালোবেসেই আড্ডায় জড়ো হচ্ছে। আবার কেউ কেউ ছোটকাগজ / বিজ্ঞাপন এইসবের ধান্ধায় শাহবাগপাড়া গরম করে রেখেছে। এদের মধ্যে সিরিয়াসলি লেখক হয়ে উঠা সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
বছর দুয়েক পরে ঢাকায় এসেছি। সময়টাকে বুঝতে পারছি একটু গভীরভাবে। এই দুই বছরের ব্যবধানে আড্ডা থেকে হারিয়েছি অনেক পরিচিত স্বজন। মৃত্যু কেড়ে নিয়েছে আহমদ ছফাকে। ছফা ভাইয়ের মৃত্যু আরেকটু বেশি কষ্ট দিয়েছে। বসন্তকালীন সাহিত্য উৎসব নামে নেত্রকোণায় একটি উৎসবের আয়োজন করা হয়। এ যাবৎ এর পুরস্কার প্রদান কমিটি যতীন সরকার, রফিক আজাদ, হূমায়ুন আহমেদ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, সেলিম আল দীন, কবীর চৌধুরী, মুহম্মদ জাফর ইকবাল, রাবেয়া খাতুন, হেলাল হাফিজ, বুলবন ওসমান, আবু হাসান শাহরিয়ার, আনিসুল হকসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ লেখক-কবিদের পুরস্কৃত করেছে। আমার এবং মাহবুব কবিরের প্রস্তাব ছিল ছফা ভাইকে পুরস্কৃত করার, করতে পারিনি। বাংলাদেশে আনন্দবাজার প্রকাশনা বিরোধি এক কর্মসূচিতে আমরা একসাথে স্বাক্ষর করেছি, আলোচনা করেছি। তার কিছুদিন পরেই ছফা ভাই মারা গেলেন। মুক্তিযুদ্ধের নির্বাচিত বইহিসেবে তাঁর ‘ওঙ্কার’ ছোট্ট উপন্যাসটি নিয়ে আমার একটি নিবন্ধ আছে। এই লেখাটিকে আমার প্রাবন্ধিক বিবৃতিতে রূপ দেবার আগ্রহ আছে। আহমদ ছফা-কে এ বঙ্গের চূড়ান্ত দার্শনিক লেখক বললে ভুল হবার কোনো অবকাশ নাই। তাঁর ‘শতবর্ষের ফেরারি: বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়’ এবং ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ বই দুটি আমি জনে জনে পাঠ করতে বলি।
২০০০-এর জুন/জুলাই নাগাদ ফরিদ কবিরের একগুচ্ছ কবিতা (গাছ, পাখি, নদী, পাহাড়, সমুদ্র এবং সম্ভবত আরো একটি ফুল নামে ) প্রকাশিত হয় প্রথম আলোর সাহিত্য পাতায়। কবিতাগুলো খুবই ভালো লাগে আমার। অসাধারণ! সঞ্চারণশীল! খোঁজ নিই এই কবির দেখা কোথায় পাওয়া যায়? কিভাবে তার সাথে যোগাযোগ করা যায়? মুজিব মেহদী সন্ধান দেন ইনি ন্যাশনাল ডায়াগনস্টিক নেটওয়ার্ক (এনডিএন)-এ চাকরি করেন। প্রথম আলোতে একদিন কবিতা দিতে যাই, সেখানে রাইসু ভাইকে জিজ্ঞেস করি ফরিদ কবিরের সাথে কিভাবে যোগাযোগ করা যায়? রাইসু ভাই সাজ্জাদ ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলেন। সাজ্জাদ ভাই মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করলেন, তাকে কি দরকার? বললাম তাঁর কবিতা ভালো লেগেছে কথা বলা দরকার। পরে জেনেছি সাজ্জাদ ভাই ফরিদ ভাইয়েরই ছোটভাই। সাজ্জাদ ভাইকে পরে বহুবার আমি অনুরোধ করেছি ফরিদ ভাইয়ের এরকম আরো একগুচ্ছ কবিতা ছাপার জন্য; কিন্তু ঈদসংখ্যা / বিশেষ সংখ্যা ছাড়া তাঁর আর কোনো গুচ্ছ কবিতা ছাপা হয়নি এখনও। ওই কবিতাগুলো ছাড়া তখনো এই কবি সম্পর্কে বিস্তর জানি না। পরে তাঁর মন্ত্র বইটি পড়ে আরো বেশি মুগ্ধ হয়েছি। একজন কবির কবিতায় সঞ্চারণ মাত্রা যেটুকু প্রয়োজন তাঁর কবিতায় আমি শতভাগই পেয়েছি। আমার বিবেচনায় এরকম সঞ্চারণশীল দার্শনিক কবি শতাব্দীতে শত শত আসে না, একজনই আসে। এ সময় আমি যাঁকে পেয়েছি, তিনি ফরিদ কবির। চোখ সকলকে দেখে নিজেকে দেখে না / দেখে না, কারণ তার চারপাশ অন্ধকারময় / স্বয়ং চোখের এই পরিণতি দেখো চক্ষুষ্মান কিন্তু অন্ধ / আমি অন্ধ, চোখের চরিত্র ঠিক বুঝতে পারি না / মানুষ নিজেকে ঠিক ততটুকু জানে / বেদনায় শরীর ভিজিয়ে ভাবে বৃষ্টিতে ভিজেছে / এইভাবে চল্লিশটি আকাশ পেরিয়ে উঠে যায় / অন্য কোনো আকাশের খোঁজে / এইকথা সব চোখ জানে / মানুষ জানে না। এরকম তাত্ত্বিক বিবৃতিতে গূঢ়প্রকাশ, সংবেদন আর বিদগ্ধতার শাব্দিক উচ্চারণ খুব কম কবির মধ্যেই প্রত্যক্ষ করেছি। কখনো কখনো তাঁর কবিতার আবেদন উদ্ভাসিত হচ্ছে স্বয়ং ঐশ্বরিক মহিমায়। তাছাড়া এই কবির মধ্যে অসম্ভব রকম প্রফেটিজম আছে। যে কারণে ফল বিক্রেতাকে আমি মহান করেছি / আর আজ তাকেই কুর্নিশ করছে তোমাদের পাখিসম্প্রদায়। তাঁর অন্য আরেকটি কবিতায় তিনি লিখেছেন, এটি আমি আমার হাওড় প্রথম সংখ্যায় কবিতা বিষয়ক একটি গদ্যে উদ্বৃতও করেছি... পোশাকেই সমস্ত রহস্য / ধর্মগ্রন্থে এসবের উল্লেখ ছিল না। পাতায় পাতায় আমি এই কথা প্রচার করেছি। নগ্ন-নারী নয়, আনারসে আছে প্রকৃত রহস্য / খোসা ছাড়ালেই আনারসমাত্র খাদ্য হয়ে ওঠে / মেঘাচ্ছন্ন রমণীরা সেই খাদ্য পরিবেশন করে। এরকম বাণীসুলভ তাঁর বেশকিছু কবিতা আছে যা আরো অনেক অনেক দিন আমার উপলব্ধি ক্ষমতাকে আরো তীক্ষè করবে, পড়বো। রাইসু ভাই ফোনে কথা বলে দেন। এনডিএন-এ ফরিদ ভাইয়ের অফিসে প্রথম যেদিন যাই মনে আছে, দোতলায় উনি কম্পিউটার রুমে বসে ছিলেন। আমাকে দেখেই জিজ্ঞেস করলেন, কার কাছে এসছেন? আমি বলি ফরিদ কবির। জ্বি আমি, বলেন কি জন্য এসেছেন? আমি মাহমুদ সীমান্ত হাওড় নামে একটি ছোটকাগজ সম্পাদনা করি। সাজ্জাদ ভাই আমাকে পাঠিয়েছেন, আপনার প্রবন্ধ ছাপতে চাই। ফরিদ ভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। কারওয়ানবাজার থেকে হেঁটে পান্থপথে তাঁর অফিসে গিয়েছি। দুপুরের প্রচ- রোদে ঘর্মাক্ত আমার কালোমুখ; নিজেরই লজ্বা লাগছিলো এভাবে কি কেউ কারো অফিসে যায়? ফরিদ ভাই আর কোনো কথা না বলে তিনতলায় তাঁর চেম্বারে নিয়ে গেলেন, অনেকক্ষণ আড্ডা দিয়েছিলাম তাঁর সাথে। ‘হাওড়’ দ্বিতীয় সংখ্যার জন্য আমাকে একটি প্রবন্ধ দিয়েছিলেন তিনি ‘প্রথাকবিতার যতো কথা’। শুধু প্রবন্ধই নয় ‘হাওড়’ শিরোনামটিও একটি মার্কার পেনে লিখে দিলেন। আমার দুর্ভাগ্য যে ওই সংখ্যাটি মুদ্রণ প্রমাদে বর্বাদ হয়ে তাঁর লেখাটি প্রকাশিত হয়। ওই সংখ্যাটিতে সাজ্জাদ ভাইয়েরও ১৩টি কবিতা আমি পুনর্মুদ্রণ করেছিলাম। ছোটকাগজ কর্মীদের মধ্যে এই ব্যাপারটি নিয়ে বেশ বিতর্কও হয়েছিল। তৃতীয় সংখ্যার জন্য ফরিদ ভাই লেখা দিলেন একটি অনুবাদ। শার্ল বোদলেয়ারের একটি বইয়ের ভূমিকার তিনটি খশড়া। লেখাটি বাংলাদেশে আর কেউ অনুবাদ করেছেন বলে মনে হয় না। এই সংখ্যাটি সুন্দর ঝকঝকে প্রকাশিত হলো কিন্তু বিশেষ ভালো হলো না। ২০০৩ সালে হাওড় চতুর্থ সংখ্যাটি মোটামুটি স্ট্যান্ডার্ড, বর্ধিত হয়েই প্রকাশিত হলো কিন্তু তিনি কোনো লেখা দিলেন না ওই সংখ্যায়। সে বছর অন্যপ্রকাশ থেকে তাঁর ‘নির্বাচিত কবিতা’ এবং প্রবন্ধের বই ‘পুরনো ও নতুন কবিতা এবং অন্যান্য’ বই দুটি প্রকাশনার জন্যেই হয়ত। যাহোক, এরপর থেকে যতদিন ঢাকায় এসেছি ওই একটিমাত্র ব্যক্তি যাঁর সাথে অফিসে বসে সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিয়েছি, কথা বলেছি, তাঁর ফোন ব্যবহার করেছি, হাত থেকে মোবাইল টেনে নিয়ে নিজের মতো ব্যবহার করেছি। সম্প্রতি আমি তাঁর বাসা থেকে কয়েকটি বই নিয়েছি যদ্যপি আমার গুরু- আহমদ ছফা, বাতাস মুদ্রণ- সিদ্ধার্থ হক, বলি যে তারানা হচ্ছে- আলতাফ হোসেন, নির্বাচিত কবিতা- অনন্য রায়, মেঘের সোনালি চুল- নাসরীন জাহান, ওল্ড ম্যান এ্যান্ড দি সী- আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, কবি ও কবিতা- টেড হিউজ, চারণ সাংবাদিক মোনাজাত উদ্দিনের কয়েকটি বই, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর সম্পাদিত গণমাধ্যম, কালিকৃষ্ণ গুহ, চৈতালী চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা, মুহাম্মদ আজীজুল হকের মনু মুহাম্মদ হিটলার এর মধ্যে দুয়েকটি ফিরিয়েও দিয়েছি। এই ফরিদ ভাই, আমি বলি আমার সর্বজনাব, বিশেষ কোনো তাত্ত্বিক বিশ্লেষণী ভূমিকায় না গিয়ে আরেকটু গভীর করে বলতে চাই বাঙালি মধ্যবিত্তের গুরুত্বের চর্চা বা যাঁর কাছে আমার সমর্পণের দায় আছে তাঁর হাত ধরেই দৈনিক আমাদের সময়-এ আমার সাংবাদিকতা, কর্মজীবনের সূত্রপাত। হাওড় চতুর্থ সংখ্যার পর কাগজটি আর প্রকাশিত হতে পারেনি। প্রায় বছর দেড়েক নেত্রকোণায় থেকে ঢাকায় ফরিদ ভাইয়ের দ্বারস্থ হই জবের জন্যে। ঢাকায় আসার সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই তিনি আমার জব নিশ্চিত করলেন আমাদের সময়-এ, পত্রিকাটির প্রতিষ্ঠাকালিন প্রথম সহযোগি সম্পাদক এবং সাহিত্যের বিভাগীয় দায়িত্ব দিয়ে। শেষপর্যন্ত আমার এ দায়িত্ব বহাল থাকেনি যদিও। পত্রিকা বাজারে চলে আসার সময়ে চ্যানেল আইয়ের সংবাদপত্রে বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের পরিচালক কাজল ঘোষের করা পেজ মিডিয়ার দায়িত্বে এবং পত্রিকাটির একমাত্র কপি এডিটর থাকাকালিন আমাকে ড্রপ করা হয়।
মোহাম্মদ রফিক ৮/৯ মাস যাবৎ অসুস্থ, একাকী ৩৫৪ এলিফেন্ট রোড তাঁর বাসায়ই সময় কাটাচ্ছেন। ফোনে খোঁজ নিই নতুন কবিতা লেখা হয়েছে কিনা। বললেন, বাসায় চলে এসো। একদিন বিকেলে তাঁর বাসায় উপস্থিত হই, নক করতেই অপরিচিত একজন দরোজা খুলে দেয়, অবাক হই ওপাশের রুম থেকে তিনি নিজেই চলে এসেছেন সামনের রুমে অতিথি-কে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এমন নির্জন! কান্নার মতো বাসাটিতে রফিক ভাই এখন কিভাবে সময় কাটান? শুধুই কি বই/কবিতা পড়ে? তাহলে সকল মৌমাছির দল? তাঁকে দেখার সেই লোকজন কোথায় যারা আমাকে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর বাসায়? কোথায় রবীন আহসান, প্রশান্ত মৃধা, মাহবুব মোর্শেদ এমনকি মুজিব মেহদী, অলকা নন্দিতা? আমি তাঁকে দেখতেই গিয়েছিলাম, আহত হয়েছি আগের রফিক আর নেই, সেই চেহারার জৌলুস, ধবধবে শাদাচুল-গোঁফ, পান-চিবানোর, গ্রাম-বাংলার কবিতার কবি। প্রায় ঘণ্টাখানেক সময় কাটিয়েছি তাঁর সাথে। আমার লেখা বেশ কয়েকটি কবিতা পড়ে শুনিয়েছি। তিনিই শুনতে চাইলেন। খোঁজ নিলেন আমার কোনো গ্রন্থ বেরুচ্ছে কিনা। আসার আগে আগে তাঁর সদ্য লেখা দুটি নতুন চমৎকার কবিতা পড়ে শোনালেন, খুব সম্ভবত যুগান্তর ঈদসংখ্যার জন্যে লেখা। আমাকে প্রতিশ্রুতি দিলেন নতুন আরও লেখা তৈরি হলেই একগুচ্ছ লেখা আমাকে দেবেন। আসার সময় পুনরায় চলে এলেন সামনের রুমে, নিজহাতে দরোজা খুলে দিলেন। আমি পেছন ফিরে তাকাইনি, তাকালেই দেখতে হবে ভগ্নকবি আমার দিকে তাকিয়ে।
এই তো আমার দেশ, শস্যময়, বাতাসের প্রসারিত বাহু
সবুজ শ্যামল মাঠে সাধের কৃষক, তার দিগন্ত বিস্তৃত
লাঙলের ব্যবহার।

এইকথা বিশ্বাসে জেনেছি, তুমি মানো কী না মানো
মশিউর নগরের দিকে ধ্যানস্থ যে মেঠো বিপুল কর্ষণে
সেইতত্ত্ব জানবে তুমি, আন্তঃনগর ট্রেনের
শোভন সিটের পাশে বসে নয়; বরং শ্যামল অন্তরায়
পা-দানির ধুলোমাখা বালকের মতো
দূরের সবুজে ডুবে, দৃষ্টি রেখে।

হোক তবু নিচে নিচে মাটির শুশ্রƒষা
নদীর কিনার ভেঙে যদি ঝরে কোনো রক্তপাত
তার জন্যে কান্না নয়, জেনে রেখো পানের বরজে
এ শুধু উর্বরতার ফলাফল কৃষকের, প্রাণের বিস্ফার
মাঠব্যাপী, ভাবো ক্ষতি নেই চিরায়ত লাঙলের
শস্য-নগরীর ফসলের প্রয়োজনে এও এক অবিরত চর্চা।

দিকে দিকে ক্ষণিকের নদী, পলি প্রতিবেশ, অরণ্য-নীলিমা
আর যত ফসলের গান চরাচরে
যাই হোক, আমার চাই সবুজ মাঠের পাশে,
চলন্ত ট্রেনের জানালায় বসে থাকা
দূরের অতিথি।
মশিউর নগর/পাতার জীবনী
জামালপুর সংস্কৃতি সম্মেলন ২০০৩, খবরটা কানে আসতেই মন চঞ্চল হয়ে উঠলো, কোনো কাজ ছিল না হাতে। প্রধান অতিথি কবি মোহাম্মদ রফিক। মনে হলো একবার ঘুরে আসা যেতে পারে। তাছাড়া জামালপুর যাইনি এর আগে। বিকেল বেলা নেত্রকোণা থেকে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে রওনা হই। ইচ্ছে হলো রাত্রিবেলাটা কবিবন্ধুদের সাথে কাটিয়ে একজন সঙ্গী খুঁজে পরদিন জামালপুর দিকে রওনা হওয়া। তখন ময়মনসিংহে গেলে সাধারণত রাত্রি কাটাই যুবা রহমান, মোর্শেদ শেখের রুমে। ওদের নিয়ে রাতের প্রথম ভাগ ব্রহ্মপুত্রের পাড় ঘেঁষে জয়নুল সংগ্রহশালার সামনে বসে গান গেয়ে, কবিতা শোনে কাটাই। বরাবরই খুঁজে বের করি চন্দন সাহা রায়, বিল্লাল মেহদী, অতনু তিয়াস, সফেদ ফরাজী। এরও আগে আড্ডায় পাওয়া যেত আশিক আকবর, মুজিব মেহদী, আশরাফ রোকন, মাসুম মোকাররম, শতাব্দী কাদের, মশিউর রহমান খান এইসব কবিকুলের। যাহোক, সঙ্গী হিসেবে পাওয়া গেল সফেদ ফরাজীকে। বিকেল বেলা উপস্থিত হই জামালপুরে। জেনে নিলাম সম্মেলন হচ্ছে বৈশাখী মেলা মাঠে। ফোন করি আমজাদ সুজনকে। পরিচিত কারা আছে, যাদের সাথে আড্ডা দেয়া যেতে পারে। ঢাকা থেকে সুজন জানালো ধ্রুবজ্যোতিঘোষ মুকুল, কাফি পারভেজ ওদের পেলে আড্ডা দেয়া যেতে পারে। অনেক চেষ্টার পরও ওদেরকে প্রাথমিক ভাবে খুঁজে পাওয়া গেল না। অবশেষে চলে যাই বৈশাখী মেলা মাঠে। গিয়ে দেখি, মোহাম্মদ রফিক বসে আছে সামনের সারিতে। দূরে দাঁড়িয়ে উৎসব পর্যবেক্ষণ করছি, রফিক ভাইয়ের চোখ আমার উপর পড়তেই হাত ইশারায় ডাকলেন। যেখানেই যাই প্রথম চোখে পড়ার ব্যক্তি ছিলাম একফুট লম্বাচুল জুটি করা, হালকা চিকন, ইষৎ কালো, লাল চোখ, নিত্য উপহারের গেঞ্জি পরা। রফিক ভাইয়ের পাশে গিয়ে বসলাম। জানতে চাইলেন কোত্থেকে এসেছি? বললাম, নেত্রকোণা থেকে। উৎসবের সময় অতিক্রান্ত করার জন্যেই খুব সম্ভবত জিজ্ঞেস করলেন সাথে কোনো কবিতা আছে কিনা? পাতার জীবনী’র পা-ুলিপি তখন শুরু করেছি। ১৭টি কবিতা মাত্র কম্পোজ হয়েছে। তুলে দিই রফিক ভাইয়ের হাতে, একটু নেড়ে চেড়ে দেখলেন, বললেন, রাতে থেকে যাও কবিতাগুলো পড়া যাবে। থেকেছি কিন্তু কবিতাগুলো পড়ার অবকাশ রফিক ভাইয়ের হয়নি। সফেদ কলেজের কাজ থাকায় রাতের ট্রেনেই ময়মনসিংহে চলে গিয়েছিল। আর আমি, টানা এক ক্লান্তির ঘুমে। সকালবেলা মোটামুটি জোরে আঘাতসহযোগে ডাক শুনতে পাই, দরোজা খুলে দেখি রফিক ভাই। বললেন, এতক্ষণ পর্যন্ত ঘুমাতে হয়! যাও দ্রুত ফ্রেশ হয়ে এসো নাস্তা সেরে নাও, এক্ষুণি বেরুবো সদরের বাহিরটা একটু ঘুরে ফিরে দেখবো। আমার ঘুমের ইচ্ছে ছিল আরেকটু বেশি, ফলে আমি রফিক ভাইয়ের সাথে বেরোইনি। পরে মনে হলো বেরুনোই উচিত ছিল জামালপুর সদর এবং সদরের বাইরের কিছু এলাকা ঘুরেফিরে দেখা যেতো। নাস্তা সেরে নিচে গিয়ে চা-সিগারেট পান শেষে দুটো পিল কিনে বাংলোয় ফিরে এসে আবার ঘুম দিই। ঘুম ভাঙে বেলা সাড়ে তিনটায়। উঠে দেখি বাংলো খালি, বাংলোয় অফিস সহকারী লোকটিকে জিজ্ঞেস করি সবাই কি চলে গেছে? বললো, হ্যাঁ সবাই চলে গেছে ট্রেন আসতে আর ১৫ মিনিট বাকি। তড়িঘড়ি করে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে চোখ কচলাতে কচলাতে স্টেশনে উপস্থিত হই। সারিবদ্ধভাবে লোকজন দাঁড়ানো, রফিক ভাইকেও দেখা গেল। তাঁর পাশে দাঁড়ানো তাঁকে বিদায় জানাতে আসা লোকজন। কোন কথা বলার আগেই রফিক ভাই বললেন দ্রুত টিকেট নিয়ে এসো, ট্রেন এসে গেল বলে। টিকিট নিয়ে আসতে আসতে ট্রেন এসে গেল। যথারীতি ফিরছি রফিক ভাই চেয়ার কোচে আমি চেয়ারে নয় বাম’পা পা-দানিতে, ডান’পা হাঁটু-ভাঙা উঠানো, পেছনে হেলান, বামহাতে স্বর্ণপাতাযোগে ধুন!
আমাদের সময় উদ্বোধনী সংখ্যায় রাহমান ভাইয়ের কবিতার জন্য শ্যামলী তাঁর বাসায় গিয়েছি। দোতলায় উঠেই দেখি গেস্টরুমে ঐতিহ্য প্রকাশনের লোকজন বসা। তাঁর পুত্রবধু টিয়া তাঁকে ধরে ধরে গেস্টরুমের দিকে নিয়ে যাচ্ছেন। দাঁড়ানো অবস্থায় আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কোত্থেকে এসছেন? কথাটি তিনি পুরোপুরি শক্ত উচ্চারণে বলতে পারছিলেন না। অসুস্থ তিনিও কাবু হয়েছেন খুব। তাঁর পুত্রবধু বাক্যটি সমাপ্ত করলেন। বললাম, দৈনিক আমাদের সময় থেকে, ফরিদ কবির আমাকে পাঠিয়েছেন। আপনি একটু বসেন আব্বু উনাদের সাথে কথা শেষ করেই আপনার সাথে কথা বলবেন। এই সময়ের কবিদের প্রধান তিনি / শ্রেষ্ঠ তিনি ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যাচ্ছেন। ১৯৯৮ সালে মুখোমুখি তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম ময়মনসিংহের মুসলিম হলে একটি অনুষ্ঠানে। সময়ের একজন রাজকবি শামসুর রাহমান আসছেন ময়মনসিংহে, খবর শুনেই চলে গিয়েছিলাম সেখানে। রাহমান ভাই ময়মনবসিংহে পৌঁছেছিলেন বিকেল নাগাদ। সন্ধ্যায় হল রুমে তাঁকে মাঝখানে বসিয়ে ছোট ছোট বাচ্চাদের নৃত্য আর ফুল ছিটানোর অপূর্ব দৃশ্যটি আমার চোখে এখনও ভাসমান। ঐতিহ্যের লোকজন দীর্ঘক্ষণ কথা বললেন খুব সম্ভবত ২০০৫ বইমেলায় রাহমান ভাইয়ের বই প্রকাশ বিষয়ে। বসেছিলাম দীর্ঘক্ষণ, লোকজন চলে যাওয়ার পর রাহমান ভাই ডাকলেন গেস্টরুমে। সোফায় বসেছি লক্ষ্য করার বিষয় আমি তাঁর দিকে তাকাতেই দেখি মুগ্ধ দৃষ্টিতে রাহমান ভাই আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নিষ্পলক। জিজ্ঞেস করলেন আপনার নাম কি? বললাম, মাহমুদ সীমান্ত। আপনি লিখেন তো? বললাম জ্বি। আমাদের সময় পত্রিকাটি সম্পর্কে জানতে চাইলেন / বিভিন্ন প্রশ্ন করলেন তৎসংক্রান্ত। এরপর তাঁর পুত্রবধু টিয়া ফাইল খুঁজে খুঁজে একটি কবিতা বের করে দিলেন। ‘গোরস্তানে কোকিলের করুণ আহ্বান’ রাহমান ভাই কবিতাটি হাতে নিয়ে কবিতাটির উপর দুটি টিকচিহ্ন দিয়ে আমার হাতে দেন। এই নামেই তাঁর পরের কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল তবে ঐতিহ্য থেকে নয় অন্য কোনো একটি প্রকাশনা থেকে।
ফিরে আসার সময় রাহমান ভাই আমার দিকে ওরকম তাকানোর অনুবাদটি ছিল এরকম, যেন খুদ কাজী নজরুল ইসলাম কবি শাসসুর রাহমান কে স্মরণ করে এক জুনিয়র নজরুল কে পাঠিয়েছেন তাঁর বাসায় আর রাহমান ভাই অভিজ্ঞ কবি সেটা বুঝে ফেলেছেন। তাই ওরকম মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে দেখছিলেন জুনিয়র নজরুল এখন তাঁর বাসায়। আমার মুখটা দেখতে অনেকটা কাজী নজরুল ইসলামের মতো। মাথায় ঝাকড়া চুল এবং চুলের মাঝখানে সিঁথি কেটে বাবড়ি করে রাখতাম আমি তাই কেউ কেউ আমাকে জুনিয়র নজরুল বলেই ডাকতো।

আমার সময় নিয়ে আরও বিস্তর কিছু গুরুত্বপূর্ণ কিছু লিখবার আগ্রহ আছে। আমার সময় আলোকিত নয় এখনো বরং আলোকিত হবে এই প্রত্যাশা করা যায়। খুব ভোরে কিছু বাতাস এসে জড়ো হলো উঠানে / এক কোণে বেলিফুলের কোনো ঝাড় ছিল না / ফলে পুষ্পঘ্রাণ শোভিত কোনো ঘুম ভাঙাও হলো না / কালোমেঘও নয় যতটা সম্ভব বৃষ্টির ঝুকি নিয়ে চলে গেছে ট্রেন / ফাঁকা রেললাইন, আমার মাতৃভূমি এখন বহুদূরে... আজ এইখানে এই সময়, আমরা কতিপয় গাছ হবো, পাখি হবো, ঝিঁঝিঁ হবো এই হবো হবো এর মধ্যেই বহতা এক শান্ত নদী আমার সময়।
২০০৫ সালের ৩১ মার্চ আমাকে আমাদের সময় থেকে সাহিত্য পাতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে ড্রপ করা হলো। সেদিন ছিল শুক্রবার। নাঈম ভাই সকালে অফিসে এসেই আমাকে তাঁর রুমে ডাকলেন। আমি আমার দুটো পিসির একটিতে নেট ব্রাউজিং-এ ব্যস্ত ছিলাম। নাঈম ভাইয়ের রুমে যাওয়ার পর উনি বসতে বললেন, লক্ষ্য করলাম নাঈম ভাই মাথাটা নিচু করে কথা বলছেন। সাহিত্য পাতার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি। সিদ্ধান্ত হতে ৬ মাস, ৯ মাস, ১ বছর সময় লাগতে পারে এর মধ্যে তুমি অন্য কোথাও জব করতে পারলে ঢুকে যাও নয়তো আমি তোমাকে স্মরণ করবো। ওই পাতার প্ল্যানিংসহ বাজেট তপন’দা আর আমার করা ছিল। আমার কণ্ঠটা ভারি হয়ে এলো, বিশেষ কিছু তাঁকে বলতে পেরেছিলাম কিনা মনে পড়ছে না। বলেছি হয়ত ঢাকায় আমার পরিচিত কেউ নেই এই এতদিন আমি কিভাবে কি করবো? আনমনেই হয়ত পেটের উপর আমার হাতটা পড়েছিল। নাঈম ভাই বললেন চাবিসহ তোমার অফিস আইডি কার্ড অফিসে বুঝিয়ে দিয়ে যেও। আমি তাঁকে সিঅফ করে আবার নেট পিসিতে গিয়ে বসে আমার ব্যক্তিগত যেসব ফাইল / লেখালেখি ছিল তা আমার ই-মেইলে ট্রান্সফার করে অফিস থেকে বেরিয়ে পড়ি। এমনিতেই আমি সেøাগতির মানুষ তার উপর প্রায় একযুগ সাহিত্যচর্চার পর যখন স্বপ্ন দেখতে লাগলাম একটি বই, হাওড় পুনরায় প্রকাশ নিশ্চিত করাসহ ছোট্ট একটি বাসা হবে যাতে একটু নিবিড় বসে নিজের টুকটাক লেখালেখি অন্তত শান্তিতে করতে পারবো। সেই তখনই, তরুণ বয়সেই শুরু হলো জবহীনতার আরেক দুঃসহ সময়। ক্রমশ নিজের চিন্তার পৃথিবীটা ধূসর হয়ে আসলো। এখন কী করবো আমি? এরকম ভাবতে ভাবতে সেদিন প্রথমে ফরিদ ভাইয়ের বাসায় গিয়েছিলাম। আসলে জবলেস হওয়ায় আমার বিশেষ কোনো উদ্বিগ্নতার কারণ ছিল না। আমাদের সময়ের গেস্ট এডিটর এবং আমার বিভাগীয় দায়িত্বে ফরিদ ভাই-ই ছিলেন। কিন্তু তাৎক্ষণিক মুহূর্তে তিনি আর আমাকে প্রোভাইড করতে পারছেন না জেনে খুবই কষ্ট হচ্ছিলো। কিছুই চিন্তা করতে পারছিলাম না। চলে এলাম পূর্ব রাজাবাজার বাসায়, সারাটা দুপুর শুয়ে থাকলাম। রাজাবাজারের ওই বাসায় থাকতাম আমাদের সময়ের ইন্টারন্যাশনাল পেজের একজন ডেস্ক রিপোর্টার, অনুবাদক, ছোটগল্পকার রবিউল ইসলাম আর আমি। অফিস থেকে বেরুনোর সময় রবি অফিসে ছিল না আর বাসায়ও ফিরে সাধারণত ১০টা/১১টায়। ওর সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পারলে ভালো হতো। ওইদিন জনকণ্ঠে নাসির ভাই, কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট নাসির আহমেদ আমার আরেকজন প্রিয় মানুষ, সাময়িকীতে ‘ধর্মফল’ নামে আমার একটি কবিতা ছেপেছিলেন। বিকেলে বাসা থেকে বেরিয়ে নাসির ভাইয়ের সাথে দেখা করার জন্য জনকণ্ঠে গেলাম। তাঁকে বিষয়টি জানালে তিনি খুব আফসোস করলেন আমার জন্য। তবে নাঈম ভাইকে কটাক্ষ করতে ভুল করলেন না। বললেন, নাঈমুল ইসলাম খানের এ ধরনের বহু বালখিল্যতার প্রমাণ আছে কিন্তু ফরিদ কী বিষয়টি নিয়ে কিছুই ভাবেনি। তাঁকে সরাসরি জবের কথা বলিনি তিনি নিজেই অনুমান করেছিলেন এ মুহূর্তে আমার একটি জব প্রয়োজন। নাসির ভাই তাঁর পাতার জন্য আমাকে একটি বই রিভিউ করতে দিলেন। লেখাটি ছাপা হলো তার পরের শুক্রবার। এভাবে প্রায় প্রতি শুক্রবার আমার লেখা প্রকাশিত হতে থাকলো। এরমধ্যে সাহিত্য বিভাগের জন্য নাসির ভাইকে আমার সিভি দিলাম। নাসির ভাই সরাসরি জবের নিশ্চয়তা দিলেন না তবে কনট্রিবিউট চালিয়ে যেতে বললেন। কারণ নিশ্চিত জবের জন্য পর্যাপ্ত কনট্রিবিউটের প্রয়োজন ছিল। এভাবে প্রায় পাঁচমাস কনট্রিবিউট চালাতে পেরেছিলাম। তারপর আর কুলাতে পারিনি অর্থহীনতা, স্থানসঙ্কুলান অগত্যা নেত্রকোণায়ই ফিরে যেতে হলো। সে কি ভয়াবহ দুঃসহ জবলেস, যন্ত্রণার তিনটি বছর। পরিচিত জনদের অফুরাণ মিথ্যাচার, ভুল বিবেচনা আর অর্থহীনতা সহ্য করেছি। রবি রাতে রুমে ফিরলে তার কাছ থেকে জানলাম সেদিন আমাদের সময় থেকে জবলেস হয়েছেন আরো কয়েকজন। সে আমার জন্য খুবই দুঃখ প্রকাশ করলো এবং নতুন জব সন্ধানের চেষ্ঠা চালিয়ে যেতে বললো। থাকার জায়গার সমস্যার কথা ভেবে বললো, আপনি আমার এখানেই থেকে যান; প্রয়োজন হলে বছরখানেক থেকে আরেকটি ভালো চাকরি নিশ্চিত করেন। তবে খাবারের টাকাটা একটু ম্যানেজ করবেন। তার কথায় থাকার আশ্বাস পেলাম। মনে হলো কিছুদিন থেকে আরেকটি ভালো জব নিশ্চিত করে ফেলবো। এভাবে সিভি দিতে থাকলাম বিভিন্ন জায়গায় আর জনকণ্ঠের কনট্রিবিউট চালিয়ে যেতে থাকলাম। যায় যায় দিন তখন প্রকাশ হবে হবে, নতুন অনেক সাংবাদিক নিয়োগ হলো। আর্ট এন্ড কালচারের দায়িত্বে তখন ব্রাত্য রাইসু। কয়েকজনের পরামর্শে তাকেও সিভি দিলাম। কিন্তু মেইলে তার জবাব দেখে আহত হলাম, সীমান্ত, এই পোস্টটার জন্য অন্য আরেকজন বিবেচনায় আছে। যতই দিন যায় ততই চাকরিহীনতার দায় বাড়তে থাকে। জুনের ১৪ তারিখ হবে রবি আমার সাথে মোটামুটি একটা দুর্ব্যবহার করলো। এমনিতেই দুশ্চিন্তার শেষ ছিল না তার উপর ইচ্ছাকৃত দুর্ব্যবহার। হয়ত তার দিক থেকে ঠিকই ছিল, সামান্য একটু কথাবার্তায় রাগ করে আমাকে রুম ছেড়ে দিতে বলে সে নিজেই তার নিজের জিনিসপত্র গুছিয়ে ফেললো চলে যাবে বলে। তারপর রুম থেকে বেরিয়ে গিয়ে তার পরিচিত একজন লোককে নিয়ে আসলো। লোকটি কোনো অবস্থাতেই আমার পক্ষ অবলম্বন করলো না বুঝলাম আমার রুম ছেড়ে দেওয়াই জরুরি। আমার হাতে কোনো টাকা ছিল না, রবি আমার কাছ থেকে অনেক আগে ধার করা ১০০ টাকা ফিরিয়ে দিয়ে সে অফিসে চলে গেলো। আমার আর কিছুদিন থেকে চেষ্টা করে একটি জব নিশ্চিত করার মতো জায়গা তখনও ছিল। আমি আমার জিনিসপত্র মোটামুটি গুছিয়ে বাসা থেকে বের হলাম, আর চিন্তা করতে থাকলাম কার কাছে যাওয়া যায়। বাসা থেকে পান্থপথ কেন্দ্র হয়ে কারওয়ানবাজার দিকে হাঁটছিলাম। মনে পড়লো গল্পকার বন্ধু ষড়ৈশ্বর্যের কথা। সে তখন বিডি নিউজ ২৪-এ জব করে। তাকে আমার অবস্থার কথা বললে সে তার রুমের চাবি আমার হাতে দিয়ে বাসার লোকেশান চিনিয়ে দিয়ে বললো তুই তোর জিনিসপত্র রুমে নিয়ে রেস্ট নিতে থাক আমি এসে পরে ডিটেল শুনবো। আমি একটা রিকশা নিয়ে আমার স্বল্প জিনিসপত্র নিয়ে ষড়োর বাসায় উঠে গেলাম। ষড়ো রাতে রুমে ফিরে অবস্থাটা জানলো এবং থাকার বিষয়ে কোনো কথা না বলে দ্রুত একটি জব খুঁজে নেয়ার তাগাদা দিলো। সকালে ষড়ো আমি দু’জনেই একসাথে বেরুলাম। ষড়ো তার অফিসে আর আমি প্রথমে জনকণ্ঠে তারপর অন্যান্য জায়গায় জবের সন্ধান করলাম। কিন্তু জবটা যেন আর কোনো অবস্থাতেই সহজ হয়ে উঠছে না। খুবই ক্লান্ত হয়ে বিকেলবেলা আজিজ মার্কেটে গেলাম সন্ধ্যার একটু আগেই মুজিব ভাই, বাবুল ভাই (গল্পকার, সম্পাদক: ব্যাস, রবিউল করিম), নিগার সুলতানা (বিএনপিএস-এ মুজিব ভাইয়ের একজন সহকর্মী ছিলেন) তাদের সাথে দেখা হলো। মুজিব ভাই আমার অবস্থা জানতে চাইলেন, তাকে অবস্থার কথা বললাম। বেশ কিছুদিন জবহীন থাকায় বোধহয় সেদিন তার আবেগকে স্পর্শ করতে পারলাম। তখন তিনি লোক-অফিসে বসা ছিলেন। রবিউল করিম, মজনু শাহ ক্ষুধা লেগেছে বলে অন্তরে লুচি খাবে বলে যাবেন, সঙ্গে আমি আর নিগার আপাও গেলাম। লোক সম্পাদক অনিকেত শামীম (শামীমুল হক শামীম)সহ কয়েকজন মিলে চিন্তা করছিলেন যে বাংলাদেশের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি করার উদ্যোগ নেবেন। মুজিব ভাই, শামীম ভাই সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলেন প্রথম ব্যক্তি আমাকে নির্ধারিত করে। আমরা নাস্তা সেরে ফিরে আসলে মুজিব ভাই ছোট্ট এই উদ্যোগে জবের অফারটি করলেন, বললেন মোটামুটি কথা বলে ফেলেছি তোর পছন্দ হলে জবটি নিয়ে নে। আমি জনকণ্ঠে কনট্রিবিউটের কথাটি জানালাম। শামীম ভাই প্রতিদিন বেলা ১টা থেকে ৪টা পর্যন্ত সুযোগ করে দিলেন জনকণ্ঠ অফিসের জন্য। আর ষড়োর সাথে থাকার বিষয়টি মুজিব ভাইসহ, বাবুল ভাই, মজনু ভাই তারাও জানলেন। শুরু হলো আমার বাংলাদেশের প্রথম লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠার জব। মুজিব ভাই অবশ্য এই জব বেশিদিন করার কথা বলেননি তবু জনকণ্ঠে কনট্রিবিউট আমার চালিয়ে নিতে হলে এই রকম একটি জবই আমার প্রয়োজন ভেবে অফারটি নিয়ে নিলাম। কিন্তু এখানে বেতনের পরিমাণ এত স্বল্প ছিলো যে যেকোন বিষয়ে আমার মুভ করাই কষ্ট ছিল।

No comments:

Post a Comment